অটিজমের ভাষা /অটিজম বৈশিষ্ট্যময় শিশুদের জন্য ভাষাভাবনা

তাওহিদা জাহান

তাওহিদা জাহান

চেয়ারপারসন, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

১. মিতুলের গল্পটা একটা নীল ভূতকে নিয়ে। সারাক্ষণ ওর নীল ভূতের ভয়। যখনই আম্মুর চোখে তাকাতে চায় ভূতটা চোখের সামনে এমন নাচানাচি জুড়ে দেয় যে, মায়ের মায়াভরা চোখটা আর দেখা হয় না। চিৎকার করে আম্মু বলে ডাকতে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু ভূতটা এত জোরে গলায় চেপে ধরে যে গলা দিয়ে কোন স্বর বের হয় না। মিতুলের খুব ইচ্ছে হয় বাবার পাশে চুপটি করে বসে রাজারানির গল্প শুনতে। কিন্তু ভূতটা সেখানে এসেও ঝামেলা শুরু করে। চুপটি করে বসে আর গল্প শুনা হয় না তার। পাশের বাসার তুতুলের সাথে ওর খুব খেলতে ইচ্ছে হয়। ভূতটা তুতুলকেও ভয় দেখায়। মিতুল খুব একা হয়ে যায়। ভূতটা বলে আমিতো আছি। কিন্তু মিতুল ওই নীল ভূতের সাথে একদম থাকতে চায় না। মিতুল ভাল নেই। একদিন সে জানতে পারে এ ভূতটার নাম নাকি অটিজম। মিতুল জানে না অটিজম কী! আমাদের চারপাশে এমন অনেক মিতুল আছে। আমরা চাইলেই পারি আমাদের মিতুলদের নীল ভূতের ভয় কাটিয়ে সুন্দর নীল আকাশ দেখাতে। এই নীল ভূতটাকে যত তাড়াতাড়ি আমারা খুঁজে পাব তত তাড়াতাড়ি আমারা এ ভূত থেকে মিতুলদের মুক্তি দিতে পারব। কিন্তু কিভাবে আমরা অটিজমের এ নীল ভূতকে খুঁজব?

 

২. অটিজম একটি স্নায়ুবিক সমস্যা যা একটি শিশুর ভাষার বিকাশ ও সামাজিকতায় বাঁধা প্রদান করে। এর ফলে শিশুরা অন্তর্মূখী (ইন্ট্রোভার্ট) হয়ে যায়, কারো সাথে মিশতে চায় না, কথা বলতে চায় না বা কথা বলার সময় চোখে চোখ রেখে কথা বলে না, খেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। পাশাপাশি পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করে। পরিশেষে, তারা সামাজিকীকরণ সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারে না। পারে না পরিবর্তনশীল সামাজিক পরিবেশের সাথে সংগতিপূর্ণ আচরণ করতে। সাধারণত একজন শিশুর ২-৩ বছর বয়সের মধ্যেই অটিজমের উপরিউক্ত লক্ষণগুলো এই আচরণগুলো পরিলক্ষিত হয়। আমরা যদি অটিজমের প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করতে যায় নিশ্চিতভাবেই তা হবে ভাষিক বা যোগাযোগ সমস্যা। তাই এই আলোচনা অটিজম শিশুর ভাষা ভাবনা নিয়েই।অটিজম শিশুর ভাষা বিকাশ জানার আগে আমাদের স্বাভাবিক ভাষিক দক্ষতা বিকাশের প্রক্রিয়া জানা দরকার। আমেরিকান ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি’র মতে, ‘একটি শিশু সহজাতভাবেই ভাষা বিকাশের জন্য তার ব্রেইনে একটি যন্ত্র নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাই শিশুর ভাষা বিকাশ একটি অত্যাবশকীয় এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়া’। ধীরে ধীরে এই প্রক্রিয়াগুলো শুরু হতে থাকে। এই ভাষা বিকাশের ক্ষেত্রে প্রাক-বাচনিক দক্ষতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসাবে কাজ করে। এবং এই প্রাক-বাচনিক দক্ষতা প্রকাশ পাওয়ার ফলে বোঝা যায় একটি শিশু স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মধ্যে বেড়ে উঠছে। জানা যাক এই প্রাক-বাচনিক দক্ষতা কি এবং কোন সময়ে কোন দক্ষতার প্রকায় পায়।সাধারণত, ৩ মাস বয়সের মধ্যে একটি শিশু দৃষ্টি-যোগাযোগ করতে শিখে যায়। অর্থ্যাৎ কেউ যখন কথা বলে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবে এবং শুনবে। এরপর, ৩-৪ মাসের মধ্যে একটি শিশু আশেপাশের আলাপচারিতায় মনোযোগ দিতে শুরু করবে এবং এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দক্ষতা। সাধারণত ৪-৫ মাস বয়সে একটি শিশু মুখ দ্বারা নানা অঙ্গভঙ্গি করতে শুরু করে এবং এর মাধ্যমে মনের নানা অনুভূতি প্রকাশ করে যাকে মৌখিক অভিব্যক্তি বলে। ৫-৬ মাস বয়সে শিশু বিভিন্ন অনুকরণ করা শেখে। এর খুব পরিচিত একটি উদাহরণ- তাকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালে সেও একই কাজ করে আমরা সাধারণ ভাষায় এটাকে ‘টাটা’ দেওয়া বলি। এছাড়া তারা ‘বাব বাব’ ‘মাম মাম’  প্রভৃতি শব্দাংশ উচ্চারণ বা ব্যাবলিং করে। এরপর ৮-১০ মাসে দেয়া-নেয়া (টার্ন টেকিং) সম্পর্ক বুঝতে শুরু করবে। অর্থ্যাৎ, তার দিকে একটা বল দিলে সে আপনাকে আবার ফেরত দিবে এবং আপনার কাছে আবার প্রত্যাশা করবে। ১০-১২ মাসের মধ্যে কার্য়-কারণ সম্পর্ক বুঝতে পারবে। অর্থ্যাৎ, একটি একটি ঘটনা ঘটার পেছনে একটি কারণ থাকবে যেমন, ‘আঁচড় দেওয়ার কারণে ব্যাথা পাবো’। ১২-১৫ মাসের মধ্যে শিশুরা বুঝতে পারে যে একটা ঘটনা অনন্তকাল ধরে চলতে পারে না বা একই কাজ বার বার করা একটি অস্বাভাবিক বা বিরক্তিকর বিষয়। যা অটিজমের শিশুরা বুঝতে পারে না তাই তারা বার বার একই কাজের পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। এরপর আস্তে আস্তে শিশুর বাচনিক দক্ষতা বিকাশ পেতে থাকে।

 

৩. অটিজম আছে এমন শিশুদের ভাষা বিকাশগত বিকাশ এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয় না। বিভিন্ন প্রভাবক তাদেরকে এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখে। ফলে তারা নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখতে চায় বা নিজেদেরকে প্রকাশ করতে চায় না। আর একারণেই অন্য স্বাভাবিক শিশুদের থেকে তাদের ভিন্নতা প্রকাশ পায়। তবে দ্রুত শনাক্তকরনের মাধমে তার সীমাবদ্ধতাগুলো কমিয়ে আমারা এ শিশুদের প্রায় স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্থ করে তুলতে পারি। এক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকার বিকল্প নেই। খেলার ছলে শিশুর যোগাযোগ ও প্রাক-বাচনিক দক্ষতাগুলো পরখ করে আমাদের বুঝতে হবে আমার শিশুকে, দেখতে হবে সে কি স্বাভাবিক ভাষা বিকাশের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বড় হচ্ছে নাকি তার মধ্যে অটিজমের নীল ভূতেরা বাসা বাধছে।

 

এ বিষয় পরখ করতে আপনার লাগবে ঘন্টা, ঝুনঝুনি, রঙিন আলোর-বল, বিভিন্ন মাপের পাজল, লেগো ও বিল্ডিং ব্লুক খেলনা, গাড়ি, বল, পুতুল, ছবি, সুইসযুক্ত পাখা, গাড়ি, মুরগী, হাঁস, কলম, লাটিম এর মত কিছু বিশেষ খেলনা। দেখা যাক এই প্রক্রিয়া-

  • শিশুকে একটু দূরত্ব রেখে তার নাম ধরে ডাকুন; পিছনে বা পাশে থেকে ঘন্টা, ঝুনঝুনি বাজিয়ে দেখুন; শিশুর চোখের সমতলে একটি সুতায় ঝুলন্ত রঙিন আলোর-বল ধরুন। প্রতিটি ক্ষেত্রে শিশু চোখে চোখে তাকাচ্ছে কিনা তা খেয়াল করুন। আপনার সাথে দৃষ্টি সংযোগের পাশাপাশি সে খেলনার দিকে দৃষ্টি সংযোগ করছে কিনা তাও খেয়াল করুন।
  • শিশু কোন খেলনার দিকে কত সময় তাকাচ্ছে তা এখানে দেখুন। শিশুকে বিভিন্ন মাপের পাজল মিলাতে দিন। দেখুন সে মনোযোগ দিয়ে এই কাজগুলো সে মনোযোগ দিয়ে করছে নাকি অল্পতেই অন্য মনস্ক হয়ে যায়
  • শিশুকে দুটি খেলনার থেকে একটি নির্বাচন করতে দিন। সে যদি দুটি বস্তুই পেতে চায় তাহলে এখানে তার সীমাবদ্ধ আচরণ পাবেন।
  • তাকে সুড়সুড়ি দিন অথবা তার প্রিয় কোনো জিনিস তার কাছ থেকে সরিয়ে ফেলুন অথবা তার চোখের কাছে হাতের আঙ্গুল ওঠা-নামা করান, দেখুন তার মুখের অঙ্গভঙ্গির পরিবর্তন হয় কি না।
  • শিশুর সাথে অনুকরণের খেলা খেলুন যেমন, হাত-পুতুল ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুর সামনে বিভিন্ন মজার অঙ্গভঙ্গি করতে পারেন এবং তাকে অনুকরণ করতে বলুন। আপনি নিজে মজার কোন মৌখিক অভিব্যক্তি করেন এবং শিশুকে অনুকরণ করতে উৎসাহিত করেন।
  • আগের খেলনা দিয়েই পালাবদল বা দেয়া-নেয়া খেলা খেলুন। প্রথমে শিশুর দিকে বার বার বল গড়িয়ে দিন। তারপর সে কী করছে তা খেয়াল করুন। যেমন: শিশুকে এবার বলটি আপনার দিকে গড়িয়ে ফেরত দিতে বলুন। সে যদি ফেরত দেয় তবে তার পালাবদলের ধারণা আছে। এবার কৌশলে শিশুর গড়িযে দেয়া গাড়ি বা বল আপনি তার দিকে গড়িয়ে না দিয়ে নিজের হাতে কিছু সময় ধরে রাখুন এবং সে অপেক্ষা করে কীনা তা পর্যবেক্ষণ করেন। শিশু বলটি পেতে অপেক্ষা করছে, তারপর অনুরোধ করছে, নাকি ছোঁ মেরে সেটি কেড়ে নিতে চাচ্ছে তাও খেয়াল করুন।
  • শিশুকে একটি রঙ্গিন সুতায় বাঁধা গাড়ি টানতে দিন, এছাড়াও শিশুকে ঘরের ভেতরের একটি হাল্কা চেয়ার ঠেলে নিয়ে মাকে বসতে দিতে বলুন। পাখা (ফ্যান) ঘুরছে, পাখা কোথায় বলতো? এভাবে মাথার উপরের পাখা দেখাতেও বলুন।
  • ৮. শিশুর সামনে একটি সুইচযুক্ত খেলনা পাখা দিয়ে দেখুন সে সুইচ টিপে পাখা চালাতে পারছে কিনা। সুইচ টিপলে ডিম পারে এমন মুরগী বা হাঁস দিয়েও এর কার্যকারণ সম্পর্ক সে বুঝতে পারে কিনা তা দেখুন।
  • শিশুকে কোন খেলনা (গাড়ি, বল) দেখান। তারপর হঠাৎ করেই শিশুর চোখের আড়ালে নিয়ে যান। এতে শিশুর কোন প্রতিক্রিয়া হয় কিনা তা খেয়াল করুন। খেলনা খুঁজতে আশেপাশে তাকাচ্ছে কিনা অথবা নিজেই খুঁজতে শুরু করে কিনা তা দেখুন। যদি না খুঁজে তাহলে তা অস্বাভাবিকতা। কারণ পৃথিবী থেকে কোনো কিছু হুট করে উধাও হয়ে যেতে পারে না।
  • শিশুকে এমন কোন খেলা খেলতে দেয়া হয় যে খেলার একটি শেষ আছে। যেমন: পাজল মিলানো, লেগো দিয়ে গাড়ি/ ঘর তৈরি করা। শিশুটি সে সরল খেলাটি শেষ করতে পারছে কিনা তা দেখুন। পাশাপাশি আপনি শেষ বলার পর সে খেলা শেষ করল কিনা তাও খেয়াল করুন। এবং একটি কাজের পুনরাবৃত্তি করেই যাচ্ছে কি না খেয়াল করুন।
  • শিশুকে দিয়ে শারিরীক অনুকরণের সাথে সাথে ধ্বনি অনুকরণের (ববব, মমম, আআআ) খেলা খেলুন। শব্দ করে এমন বিভিন্ন খেলনার সহায়তাও নেয়া হয়। এর মাধ্যমে শিশুর কণ্ঠস্বরের উপস্থিতি লক্ষ্য করুন।

উপরের খেলাগুলো মাধমে আপনি নিজেই আপনার শিশুর অটিজম আছে কিনা তা প্রাথমিকভাবে পরখ করতে পারেন। আপনার কাছে কোন কিছু ব্যতিক্রম মনে হলে, দেরি না করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। অটিজমের লক্ষণ প্রকাশ পেলে এবং তা যদি দ্রুত শনাক্ত করা যায় তাহলে স্পিচ থেরাপির মাধ্যমে তা অনেকাংশে স্বাভাবিক করে তোলা যায়। এবং নিজেরাও উপরিউক্ত কৌশল ব্যবহার করে তাদের প্রাক-বাচনিক দক্ষতাগুলো চর্চা করুন। বাচ্চাকে সময় দিন। ভাষা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করুন। নতুন নতুন বিভিন্ন উপকরণের সাথে নিয়মিত পরিচয় করিয়ে দিন। সবসময় তাদের মৌলিক ক্রিয়াকলাপগুলো নিজেরা করিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকুন ফলে তার মধ্যে যোগাযোগ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি হবে। এবং প্রয়োজন অনুযায়ী যোগাযোগ করার প্রবণতা তৈরি হবে। সে যদি বুঝতে না পারে যে কেনো যোগাযোগ করতে হয়? তাহলে, স্বাভাবিকভাবেই সে যোগাযোগ করবে না। এবং প্রয়োজনে স্পিচ থেরাপি সেবা নিতে হবে। শিশু বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি যোগাযোগ করতে পারেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ; বিশেষায়িত স্কুল-প্রয়াস, সোয়াক, তরী ফাউন্ডেশন; সিআরপি, সাভার ও অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন এর সাথেও। আমাদের বিশ্বাস, একদিন আপনার শিশু নিজেই লিখবে তার ‘নীল ভূত’ জয়ের গল্প।